(পূর্ববর্তী 'সূচনা' পর্বটি পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে)
প্রথম পর্ব
৫ই এপ্রিল, ২০১৯
ঋজুর অফিসে আমি হাজির হয়েছি প্রায় দুটো পঞ্চাশ। বাইরে প্রচুর গরম। অফিসের এসিতে বসে জিরোতেই একটা ঠান্ডা লেবুর সরবত চলে এল। ঋজু মাইতি বাড়ির কান্ড নিয়ে খবরের কাগজের কাটিংগুলো গুছিয়ে রেখেছিল। আমি আসতেই বাড়িয়ে দিল। আমি একটা একটা করে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। ঋজু কমপিউটারে ওর ব্যবসার কোনো কাজে ব্যস্ত। এভাবে খানিকক্ষণ চুপচাপ কেটে যাওয়ার পরে দরজায় দুটো টোকার আওয়াজের সাথে একটা গলার আওয়াজ ভেসে এল
- আসতে পারি?
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটে কুড়ি বাজে। ঋজুও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল
- হ্যাঁ, আসুন প্লিজ। আমি প্রত্যয় সেন। আর ও আমার বন্ধু সন্দীপন ঘোষ।
এক মহিলা। বয়স বত্রিশ -চৌত্রিশের আশেপাশে। হাতে একটা প্লাস্টিক নিয়ে অফিসে প্রবেশ করলেন। গায়ের রঙ ফর্সা। পড়নে একটা কচি কলাপাতা রঙের সালোয়ার কামিজ। চুল পেতে আঁচড়ে ব্যাকক্লিপ করা। চোখেমুখে অবসাদ ও শোকের ছায়া। ওনার পেছনে এলেন আরেকজন। বয়স চল্লিশোর্ধ্ব। সামান্য স্থুল চেহারা। পোশাক ধোপদুরস্ত। গায়ের রঙ ফর্সা। চেহারা এবং হাবভাবই বলে দিচ্ছে যে ভদ্রলোক বেশ বিত্তশালী। সোনার আংটি পরা ডানহাতের তর্জনী ও মধ্যমাতে। বাঁ হাতে ধরা আছে একটা বেশ দামি স্মার্টফোন।
মহিলা ঘরে ঢুকে বললেন
- আমিই অনামিকা পালুই।
ঋজু ওনাদের সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল
- প্লিজ বসুন। আমি প্রত্যয় আর ও আমার বন্ধু সন্দীপন। বলুন যা বলার আছে।
আমি টেবিলের এপাশে একটু সরে বসলাম। ভদ্রমহিলা বসলেন ঋজুর উল্টোদিকে, আমার পাশের চেয়ারে। আর ভদ্রলোক বসলেন তার ডানপাশে।
ঋজু একটা জলের বোতল এগিয়ে দিল। ভদ্রমহিলা বোতল খুলে দু-ঢোক জল খেয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বার করতে করতে বললেন
- প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট যেটুকু আছে নিয়ে এসেছি। কেস ফাইল করতে বলেছে আমার উকিল। আপনিও একবার দেখে নিন, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। উকিল বলছিল সরাসরি ৩০২ ধারা না ফেলে...
ঋজু কথা কেটে ওর চেয়ারে স্বভাবসিদ্ধ হেলান দিয়ে বলল
- ওসব আইনের মারপ্যাঁচ আমরা তেমন বুঝবো না। অপরাধের তদন্ত করতে ভালো লাগে তাই করি। ওসব দেখলে আমার বরঞ্চ অসুবিধাই হবে। আপনি ধীরেসুস্থে যতটা সম্ভব আমাদের বলুন। আমরা তার নির্যাসটুকু নিয়েই কাজ শুরু করব। পুলিশি তদন্ত তো চলছেই। দেখা গেল আমাদের আগে ওনারাই কিনারা করে ফেললেন।
মহিলা কথাটা শুনে মনেহয় খুশি হলেন না। বললেন
- তাহলে আর আপনাদের কাছে আসতাম না।
আমি আশ্বস্ত করার জন্য বললাম
- আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। একদম প্রথম থেকে বলুন।
ঋজুও নিজের মোবাইল বার করে টেবিলে রেখে বলল
- হ্যাঁ, বলুন।
বুঝলাম যে ও ফোনের রেকর্ডারটা চালিয়ে দিল।
ভদ্রমহিলা শুরু করলেন
- আমার বাবার জন্মদিন ছিল ২২শে মার্চ। দোলের পরের দিন। দোলের দিন আমরা এসেছিলাম। তো, সেদিনই প্ল্যান হল যে এবারে বাবার জন্মদিন সেলিব্রেট করব। পঁচাত্তর বছরে পড়বে, কতদিন থাকে আর তার তো ঠিক নেই। এখন বুঝতে পারছি,এসব ভাবনা সত্যিই অমঙ্গল ডেকে আনে!
কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। আমরা দুজনেই নির্বাক এবং ওনাকে সময় দিতে ইচ্ছুক। অকস্মাৎ এমন শোকাহত হলে মানুষমাত্রেই যুঝে উঠতে সময় লাগে। দীর্ঘসময় পরে সে শোকের ওপর প্রলেপ পড়ে। আবার প্রসঙ্গে ফিরলেন
- বড়বৌদি, বড়দা, ও (পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন), সবাই রাজি। বড়দা বাজার করেছিল। ও কেক অর্ডার দিয়েছিল। পোলাও, মাংস, ফিসফ্রাই। বড়বৌদি, আমি, কল্পনা মিলে রান্না করেছিলাম।
ঋজু হঠাৎ ওনাকে থামিয়ে বলল
- আপনাকে একটু থামাচ্ছি। ওনার পরিচয়টা যদি বলেন।
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পাশের লোকটিকে দেখিয়ে বললেন
- ও হ্যাঁ হ্যাঁ, সরি,ও পলাশ,আমার স্বামী।
- আর কল্পনা?
- কল্পনা আমাদের বাড়ির কাজের লোক। খুবই বিশ্বস্ত। কোথাও সোনার জিনিস পড়ে থাকলেও নেবে না, এমন।
ঋজু প্রসঙ্গে ফিরিয়ে নিতে চাইছে
- হ্যাঁ, তারপর বলুন। সেদিন একসাথে সবাই রান্না করছিলেন। আর পায়েসটা কে রান্না করেছিলেন বললেন?
- বড়বৌদি। তবে আমি, কল্পনা সবাই হাত লাগিয়েছি।
- আর বাড়ির বাকিরা তখন কোথায়?
- তিনতলায়। বাবা, বড়দা,পলাশ আর দীপু মিলে খেলা দেখছিল।
- দীপু কে?
- আমার ছোটভাই।
- কী খেলা?
- ফুটবল।
পলাশবাবু যোগ করলেন
- ইউরোপীয়ান লিগ।
অনামিকাদেবী আবার বলতে শুরু করলেন
- মেজদা দোতলায় ছিল। আর দিপু প্রথমদিকে ছিল। তারপর কখন যে উঠে গেছে ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। আমরা সবাই একসাথে খেলাম। বড়বৌদি আর কল্পনা মিলে আমাদের পরিবেশন করল।
ঋজু টেবিলের সামনে একটা গোল কাঁচের পেপারওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল
- আর পায়েস? যাতে বিষ মেশানো হয়, সেই পায়েস খেয়েছিলেন আপনারা? পায়েসে কী কী ছিল?
- পায়েসে যা যা দেয় সবই দিয়েছিল বড়বৌদি।
- যেমন?
- যেমন দুধ, গোবিন্দভোগ চাল, কাজু, কিসমিস এসব।
- মনে পড়ছে এমন কিছু যা সবাই দেয় না?
অনামিকা দেবী চোখ ওপরে রেখে খানিকটা মনে করার মত মুখ করে বললেন
- সম্ভবত বড়বৌদি পেস্তাবাদাম দিয়েছিল। পেস্তা কিন্তু সবাই দেয় না।
এরপর পালুই দম্পতি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে বলল
- আসলে অতোটা খাওয়ার পর পায়েস খেতে আর মন চায়নি। পায়েসটা রাখা ছিল দোতলায়। মেজদার ঘরের ফ্রিজে। সেই রাতে যদি পায়েসটা খেতাম, তাহলে তো আমাদেরও এক অবস্থা হত।
- বাকি সবাই পায়েস খায় এবং মারা যায়। তাই তো?
- হ্যাঁ, তবে বনানী ছাড়া। বনানী খেয়েছে এবং দিব্যি বেঁচেও গেছে। ওর কিছুই তেমন হয়নি।
কথা কেটে নিয়ে ঋজু ভুরু দুটোকে ওপরে তুলে বলল
- বনানী কে?
- বনানীর মা আমাদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করতো। হঠাৎ মারা যায়। মেয়েটা পড়াশোনা শিখেছিল। ভালো ব্যবহার। তাই আমার বাবা ওকে পলাশের গোডাউনের হিসেবের কাজে লাগাতে বলে। ভালোই কাজ করে। সাথে বাবারও বিভিন্ন কাজ করতো। এই ধরুন ব্যাঙ্কের কাজ, ট্যাক্সের কাজ এইসব। বাবার ওষুধপত্রগুলোও ও ঠিক করে গুছিয়ে রাখতো। এখন এই ঘটনার পরে তো আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেছি!
- আচ্ছা, তারপর?
পলাশ পালুই বলতে শুরু করলেন
- আসলে শ্বশুরমশাইয়ের ফ্রিজটা দীর্ঘদিনের পুরনো তাই ভালো ঠান্ডা হয় না। মেজদার ঘরের ফ্রিজটা নতুন। তাই পায়েসটা ঠান্ডা খেতে ভালো লাগবে বলে সেদিন মেজদার ফ্রিজে রাখা হয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য।
ঋজুর পরবর্তী জিজ্ঞাসা
- সমস্ত ঘটনা একটু সময় অনুযায়ী পর পর বললে ভালো হয়। তাহলে পায়েসটা দোতলায় এল কখন?
অনামিকা পালুই উত্তর দিলেন
- সময়টা তো ঠিক খেয়াল নেই। আমাদের মেয়ে ঝুমির সেদিন অন্য একটা জন্মদিনের নিমন্ত্রণ ছিল। আমার শাশুড়ি ঝুমিকে নিয়ে যাবে বলে আমি আর পলাশ বেরোই পৌনে সাতটা নাগাদ। ভবানীপুরের বাড়িতে আসি তখন পৌনে আটটা। আমি ফিশফ্রাই ভেজে তারপর বনানীকে খাবার দেওয়ার জন্য ডাকতে যাই। ওর দরজার তালা আমিই খুলি। তারপর বনানী খাবার নিতে আসে। পায়েসটা রাখতে দেওয়া হয়। বনানী আর বড়বৌদি ছিল। ওরাই নিয়ে গেছিল।
ঋজু অবাক হয়ে বলল
- কীসের তালার কথা বললেন?
পলাশবাবু উত্তর দিলেন
- আসলে, বনানীর ঘরের দিকের একটা দরজা খোলে সিঁড়ির নীচে। ও চাইলে আগে ভেতরে ঢুকতে পারতো।
- তাই অবিশ্বাসের জন্য তালা লাগানো ছিল?
অনামিকা পালুই বললেন
- অবিশ্বাস ঠিক নয়। আসলে মেজবৌদিই উদ্যোগ নিয়ে তালা দিয়েছিল। বনানী হঠাৎ করে যখন-তখন বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেত। সেটা মেজবৌদির পছন্দ হত না। একদিন এই নিয়ে অশান্তি হয়েছিল। তাই তালা দেওয়া হয়েছিল।
- কিরকম অশান্তি?
অনামিকা পালুই বললেন
- সেটা ঠিক বলতে পারব না। বড় বৌদি ফোনে বলেছিল আমাকে। তাছাড়া মেজবৌদির সাথে প্রায় সবারই ঝগড়া-ঝামেলা হয়। তাই আর মাথা ঘামাইনি। সেদিনের প্রোগ্রামের প্ল্যানটা হয়েছিল মেজবৌদি না থাকার জন্য। নাহলে তো বাপের বাড়িতে যাওয়াই কমিয়ে দিয়েছি ওই মহিলার জন্য। মেজদাও এখন কেমন একটা যেন হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গে আনার জন্য ঋজু বলল
- তাহলে, সেদিন আপনার বড়বৌদি আর বনানী মিলে আপনার মেজদার ঘরে গিয়ে যখন পায়েস রাখেন তখন কটা বাজে?
কথোপকথন চলছিল পলাশবাবু আর ঋজুর মধ্যে। এবার অনামিকাদেবী বললেন
- না না শুরু থেকেই বলছি, শুনুন। তখন সোয়া আটটা হবে, ফ্রাই ভাজা হয়ে গেলে বড়বৌদি বনানীর কথা বলল। বলল মেয়েটা একা থাকে,ওকে ডেকে আনতে। বনানী এলে ওকে খাবার দেওয়া হয়। এরপর বড়দা বলল যে পায়েসগুলো ঠান্ডা খেতেই ভালো লাগে। তখন বৌদি সবার পায়েসগুলো কতগুলো বাটিতে নিল। বনানীও সঙ্গে ছিল।
পাশ থেকে পলাশবাবু বললেন
- বাটি না। আইসক্রিম কাপে ছিল পায়েসগুলো। স্টিলের কাপের সেট ছিল।
- বেশ। তারপর?
- এরপর আমি কেক আনতে চলে যাই।
অনামিকাদেবী বললেন
- পলাশ কেক আনতে বেরিয়ে যাবার পর আমি আর বড়বৌদি মেজদাকে ডাকতে গেলাম। মেজদা একা ছিল। আমার ছোটভাই তখনও তিনতলাতেই ছিল। ফুটবল খেলা চলছিল। এরপর আমি আর বড়বৌদি বড়দার ঘরে গিয়ে বসেছিলাম। পলাশ কেক এনে কলিং বেল বাজায়। আমি নামতে যাচ্ছিলাম তখন বনানী বড়বৌদিকে ফোন করে নামতে বারন করে। বলে যে ও দরজা খুলে দিচ্ছে। কারণ, তখনও ওর ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। আমি বড়দার ঘরে খাটে পা মেলে দিয়ে শুয়ে থাকি। আর বৌদি ঢোকে বাথরুমে। পলাশ কেক এনে খাওয়ার ঘরের টেবিলে রেখে আমাদের ডাকতে আসে। তখন পৌনে নটার কাছাকাছি। আমি বেরিয়ে আসি কারণ তখন বৌদি শাড়ি পড়ছিল। এরপর বাবার কেক কাটা হয়। কেক খেয়ে আমি,পলাশ, মেজদা, বড়দা খেতে বসি। কল্পনা আর বড়বৌদি সার্ভ করে। তারপর কল্পনাকে টিফিনকৌটোয় খাবার দিয়ে বড়বৌদি খেতে বসে। আমি কল্পনাকে নিয়ে নীচে নামি আর দরজা বন্ধ করে দিই। বড়বৌদিকে খাবার দিচ্ছিলাম বলে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যাই। নাহলে তখন দীপুর ঘরে গেলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত। সবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর বড়বৌদি পায়েস আনার কথা বলে দোতলার ফ্রিজ থেকে। আমার আর পলাশের আর খেতে ইচ্ছে করল না। পেট ভরা ছিল। দেরীও হয়ে গেছিল। মেয়ে পাশের বাড়িতে জন্মদিনে গেছিল। তাই আমরা বলি যে আমরা আর পায়েস খাব না। বড়বৌদিকে বলে দিই যে আমরা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে পায়েস নিয়ে উঠে আসতে। তাহলে বারবার ওঠানামা করতে হবে না। বড়দা আর বাবা তখনও টেবিলে বসে ছিল। মেজদা খেয়ে আমাদের আগেই নীচে নেমে যায়। দীপু নীচে নেমে যায়। বড়বৌদি ওকে ফোন করে ডাকতে ও বলেছিল যে পরে খেতে যাবে। আমার ছোটভাই বরাবরই ভীষণ খামখেয়ালি। তাই আমরা কিছু সন্দেহ করিনি। দশটা নাগাদ আমরা বাবাকে বলে চলে আসি। বাবা আমার হাতটা ধরে বলেছিল যে আসছে পয়লা বৈশাখের দিন সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করবে। আমিও বলেছিলাম।
মহিলা আর কথা বলতে পারলেন না। গলা বুঁজে এসেছে। কান্নায় টলটলে চোখ। ঋজু টেবিলের ওপর ঝুঁকে গোল পেপারওয়েটটাকে দুটো আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে দিতে দিতে মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বের করে বলল
- হুম....সবই তো বুঝলাম। এবারে আপনারা বরঞ্চ আমার যে সব জায়গায় খটকা সেগুলো ক্লিয়ার করুন। প্রথমত, আপনার ছোটভাইয়ের ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হল না। উনি তো ওপরে ছিলেন। খাওয়াদাওয়া করার আগে উনি কেন নেমে এলেন? কোনো মনোমালিন্য বা অস্বাভাবিক কিছু?
অনামিকাদেবী বললেন
- না মনোমালিন্য কিছুই হয়নি। বরঞ্চ সেদিনকে ওর মুড ভালোই ছিল। ইয়ার্কি মারছিল আমাদের সাথে। কিছুদিন আগেও একটা মন কষাকষি ছিল। আমরাই বুঝিয়েছি বাবাকে।
- কারণ?
- কারণ, বনানী। বাবা দীপুকে বিয়ের কথা বলছে অনেকদিন ধরেই। কয়েকদিন আগে বড়বৌদি বলল, দীপু নাকি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। বনানীকে পাত্রী হিসেবে চাইছে। বনানীর মা যেহেতু আমাদের বাড়িতে কাজের লোক ছিল তাই বাবার এ বিয়েতে মত ছিল না। মেজদা আর মেজবৌদিও বনানীকে চরম অপছন্দ করে। এই নিয়ে বেশকিছুদিন ধরেই বাড়িতে মন-কষাকষি চলছিল। মেজবৌদির অনুপস্থিতিতে আমি আর পলাশ বাবাকে বুঝিয়েছি। মোটামুটি রাজি হয়ে গেছিল।
কথাগুলো মন দিয়ে শুনে ঋজু বলল
- আচ্ছা বেশ। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, কোনো পারিবারিক শত্রুতা আছে নাকি?
- পাশের বাড়ির কাকাদের সাথে সম্পর্ক ভালো নেই। তবে, এতটা শত্রুতা কেউ করবে বিশ্বাস করতে মন চায় না। আর তাছাড়া তাদের বাড়িতে ঢোকার কোনো পথ ছিল না বুঝলেন। দরজা বন্ধ ছিল। শত্রুর ঢুকতে গেলে চাবি লাগবে। তবে, চাবি একজনের কাছে ছিল।
- কার কাছে?
- আমার মেজবৌদি। ও সবকিছুই আলাদা রাখে। মিলেমিশে চলতে পারে না বুঝলেন। এই তো কদিন আগেই দোতলায় আলাদা রান্নাঘর করলো। দরজার সমস্ত চাবি সে আলাদা রাখতো। এবং সেই চাবি তার কাছে ছিল।
- হুম... আমার তৃতীয় প্রশ্ন, আপনারা কাকে কাকে সন্দেহ করেন?
- দেখুন, ব্যাপারটা খুব পরিস্কার হত যদি বনানীর দরজাটা না বন্ধ থাকত। মেজবৌদির কাছে একমাত্র বাড়ির দরজার ডুপ্লিকেট চাবি থাকে বুঝলেন। আর ঘটনার পর থেকে মেজবৌদির আচরণও ঠিক নেই।
- কিরকম?
- মেজবৌদির বক্তব্য, বড়দার ভাগ, বাবার ভাগ, বাড়ির সমস্ত ভাগ তাকে দিতে হবে। কারণ, ও বড়দার ছেলের কাস্টডি নিতে চায় বুঝলেন। মেজবৌদি ঘটনার পর থেকে হঠাৎ বলতে শুরু করেছে যে এখন যে তালাটা মারা আছে সেটা নাকি আগে ছিল না। অন্য তালা ছিল।
পলাশবাবু বলে উঠলেন
- মহিলা বাজে কথা বলছেন। যে তালাটা লাগানো ছিল সেটাই আছে। মহিলার সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবেন, মহিলার মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই।
অনামিকাদেবীও সায় দিলেন
- এ ব্যাপারে আমিও সহমত বুঝলেন। তালাটা আমিও দেখেছিলাম। আর মেজবৌদির ব্যাপারে বলব, মহিলা শুধু পাগল নয়, বদমাইশও। কোনদিন আমি দেখিনি মেজবৌদিকে দোলের সময় বাপের বাড়ি যেতে। এবছর বাপের বাড়িতে গেল আর এই ঘটনা। আবার সাথে বাড়ির দুটো বাচ্চাকেও নিয়ে গেল। সেটাও কিন্তু ভাববার বিষয়।
ঋজুদের বাড়ির একজন কাজের লোক ওনাদের দুজনকে ঠান্ডা লেবুর সরবত দিয়ে গেল।
ঋজু জিজ্ঞেস করল
- তাহলে কাকে বা কাদেরকে সন্দেহ করছেন?
অনামিকা দেবী বলল
- দেখুন বনানী এবং মেজবৌদি,এই দুজনের ওপরেই সন্দেহ বেশি। বনানীর চান্স ছিল। যদিও তার দরজা বন্ধ ছিল। আর মেজবৌদির চরিত্রগত দিকটার জন্য সন্দেহ করতেই হচ্ছে। তবে, বাইরের লোক যে কেউ ঢোকেনি সেটাও ঠিক পরিষ্কার করে বলতে পারছি না। একটা দরজার চাবি মেজবৌদির কাছে থাকে। সে এখন বলছে সেটা নেই। সবশেষে দেখা যেতেই পারে হয়তো আমার ছোটভাইই বিষটা মিশিয়েছে, তবুও আমি নিশ্চিত হতে চাই। প্রমাণ ছাড়া পুলিশও কাউকে গ্রেফতার করতে নারাজ।
পলাশবাবু বললেন
- আমরা রাতে বনানীর ঘরে বড়বৌদিকে যে তালা মেরে দিতে দেখেছি,সেই তালাই মারা ছিল। সকালে গিয়েও দেখেছি। আমার স্ত্রী মানতে পারছে না। আমার মনে হয় আমার ছোটশালাই সব ঘটিয়েছে। অথবা মেজবৌদি কাউকে দিয়ে করিয়েছে।
আমি অনামিকাদেবী কে জিজ্ঞেস করলাম
- আচ্ছা, এমন হতে পারে না যে অন্য কেউ বাড়ির মধ্যে ঢুকে পায়েসে বিষ মিশিয়ে বেরিয়ে গেছে?
- এক তো আমাদের বাড়ির আর কোনো দরজা নেই ঢোকার। আর বিষ মেশাবেই বা কখন? আমরাই তো রান্না করে রেখেছিলাম। একমাত্র বনানীর ঘর যখন খোলা ছিল, তখনই কেউ মেশাতে পারবে বুঝলেন। আর বনানীর ঘরে বনানী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাই বনানীকেও পুরোপুরি ছাড় দেওয়া যায় না।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম
- আপনাদের সাথে কাকাদের কেমন শত্রুতা?
- ওরা আলাদা বাড়িতে থাকে। কোনো যোগাযোগ নেই বুঝলেন। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানির নাম নিয়ে কেস চলছে বাবার সাথে। যাতায়াত নেই। তবে, আমাদের কাজের লোক কল্পনা ওদের বাড়িতেও কাজ করে। ফলে, দু-বাড়ির খবর দুদিকে চালাচালি হয়।
ঋজু সব শুনে বলল
- ঠিক আছে। আমাদের একবার আপনাদের বাড়িটা দেখতে যেতে হবে। পুলিশ কি সিল খুলে দিয়েছে? ভেতরে ঢুকতে পারব?
- হ্যাঁ, গত সপ্তাহেই খুলে দিয়েছে। কবে যেতে চান বলুন?
- আপনারা তো এখন বেলঘড়িয়া থেকে এসেছেন?
- হুম,আমি এখন এসেছি। পলাশের তো এখানেই গোডাউন। গাঁজা পার্কের পেছনদিকটায়। ও সকালেই এসেছে।
- আবার কবে আসছেন? আপনারা থাকাকালীন গেলেই ভালো। নাহলে, আপনাদের সময় থাকলে আজকেই সেরে ফেলতাম। কিরে স্যান্ডি?
শুক্রবার বিকেলের পর থেকে এমনিতেই আমার তেমন কাজ থাকে না। এই সপ্তাহে শুধু শনিবার সকালে মাকে নিয়ে একটু মন্দিরে যেতে হবে। এছাড়া এই উইকএন্ডে কোন কাজ নেই। বললাম
- হ্যাঁ চল, আমার অসুবিধা নেই।
পলাশবাবু বললেন
- কাজের কথা তো হল। আপনাদের ফিসটা?
ঋজু বলল
- দেখুন আমাদের বেশিরভাগ কেসে যাতায়াত খরচ অনেক থাকে। এখানে সেটা নেই যেহেতু আমার পাশের পাড়ার কেস। কী আর বলি!
ঋজুর ইতস্তত ভাব দেখে আমি বললাম
- ঠিক আছে,হয়ে গেলে পঞ্চাশ হাজার দিয়ে দেবেন।
আমি আর ঋজু দুজনেই ওনাদের বলে দিলাম চলে যেতে। আমরা রওনা দিলাম ঋজুর বাইকে আধ ঘন্টা পরে।
ক্রমশ...
পরবর্তী পর্বটি পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে
পূর্ববর্তী পর্বটি পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে
(বুকমেকার্স ও বন্ধুরা - শারদীয়া ১৪২৭ -এ প্রথম প্রকাশিত। অলঙ্করণঃ আশিস ভট্টাচার্য)
Comments