top of page
Writer's pictureপ্রদীপ্ত দে

ভেঙে মোর ঘরের চাবি - সূচনা

Updated: Dec 11, 2021





সূচনা


"ওফ্! কতবার করে বলব ম্যাডাম? দরজা বন্ধ ছিল। কেউ কোনভাবেই ভেতরে যেতে পারে না।"


― মেয়েটির নাম কল্পনা। বয়স সাতাশ। মাইতি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে মেয়েটি। লেডি ইন্সপেক্টর গায়ত্রী ঝায়ের বারবার এক‌ই প্রশ্নের উত্তরে এবারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মেয়েটি। লেডি ইন্সপেক্টরের সেদিকে বিকার নেই। প্রশ্নটা করেই সে একে একে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের পাতা ওল্টাতে লাগল। দুটো ভুরু কুঁচকে ওপরে উঠে আছে। হাবেভাবে বিরক্তি। হবেই না বা কেন? এক সপ্তাহ গড়িয়ে গেল অথচ এত বড় একটা ঘটনার সমাধানসূত্রের টিকিটার‌ও দেখা মিলল না। পুলিশমহলে সবাই হতাশ। বিপর্যস্ত মিডিয়ার মুহুর্মুহু সমালোচনায়। একটা নয়,দুটো নয়, চারটে খুন। সাথে একটি বিভ্রান্তিকর আত্মহত্যা। মাইতি পরিবার শহরের এক নামকরা বিস্কুট কোম্পানির নির্মাতা। তাই শোরগোল একটু বেশীই হল। খুন হ‌ওয়া পরিবারের নিকটাত্মীয়েরা থানায় এসে রোজ হানা দিচ্ছে দ্রুত অপরাধীর নাগাল পাওয়ার জন্য। আর পুলিশমহলের হাতে আশু সমাধান দূর‌স্ত।


ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনা।


২৩শে মার্চ ২০১৯। সকাল সাতটা দশ। কলকাতা শহর ঘুমচোখে সবে সবে আড়মোড়া ভাঙছে। কাগজ‌ওয়ালা সাইকেলে করে এক একটা বাড়িতে ছুড়ে ছুড়ে দিয়ে যাচ্ছে মোড়ানো খবরের কাগজ। দুদিন আগেই দোল উৎসব ছিল। বিভিন্ন বাড়ির দেওয়ালে, রাস্তায় আবির আর রঙখেলার চিহ্ন এখনো বেশ তাজা। ভবানীপুরের পুরনো তিনতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে তিনবার হুইসেল বাজালো কর্পোরেশনের ময়লা নেওয়ার লোক বাজু ধানুক। একতলার একপাশে থাকা মহিলাকে তার ময়লা ফেলার সময় জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর না পেয়ে এগিয়ে গেল। দশ মিনিট ধরে সদর দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মোহন পান্ডেও। মাইতি পরিবারের দীর্ঘদিনের ড্রাইভার। চোদ্দোবার কলিং বেল বেজে গেছে। তবুও কারোর সাড়াশব্দ নেই। রাস্তার সামনেই বাড়ির লম্বা বারান্দা। সেখানেও কারোর দেখা নেই! হল কী!! তার দশ বছরের কর্মজীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি কখনো। আশপাশের দোকান-বাড়ি থেকে ক্রমশ লোক জড়ো হতে শুরু করেছে। তারাও এমন ঘটনায় হতচকিত। এবারে ফোন গেল ভবানীপুর থানায়। মিনিট দশেক লাগল পুলিশের জায়গায় পৌছাতে। ততক্ষণে এসে হাজির হয়েছে বাড়ির পরিচারিকা কল্পনা দাস।


পুলিশ এসে বারকয়েক কলিং বেল বাজাল। তারপর দুজন ষন্ডামত লোককে দিয়ে গাইতি মেরে ভেঙে দিল দরজার লক। পুলিশের সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাড়া-প্রতিবেশী। কাঠের বড় সদর দরজা পেরোলেই অল্প একটু জায়গা সিঁড়িতে ওঠার আগে। পুরনো দিনের ঝকঝকে লাল সিমেন্টের মেঝে। বাঁদিকে একটি কাঠের দু-পাল্লার দরজা। সেখানে একটা তালা ঝুলছে। সিড়িতেও লাল সিমেন্ট। সিঁড়ির দুধারে হলুদ আর কালোর নকশা। দোতলায় উঠে সামনে আসে একটা গ্রিলের গেট। সেটা খোলাই ছিল।


গ্রিলের গেট পেরোলেই দুদিকে চ‌ওড়া বারান্দা আর ডানদিকে ঘুরে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলা এবং তিনতলার বারান্দা বরাবর চারখানা বড় ঘর। বারান্দার দুপাশে প্রতিটা তলায় শেষের দিকে দুটো করে বাথরুম।


বাড়ির মেজ ছেলে অতীন তার পরিবার নিয়ে থাকেন দোতলার ডানদিকের দুটো ঘরে। বাঁদিকের অন্য দুটো ঘর ছোট ছেলে অজয়ের। বড় ছেলে অরুণ থাকে তিনতলার বাঁদিকের দুটো ঘরে। আর ডানদিকের প্রথম ঘরে থাকেন বাড়ির বড়কর্তা অলোক মাইতি। বড়গিন্নী বছর পাঁচেক আগে স্বর্গবাসী হয়েছেন। দ্বিতীয় ঘরটি হচ্ছে বাড়ির সাধারণ রান্নাঘর এবং খাওয়ার ঘর।


বাড়িতে ঢুকেই তরতরিয়ে ওপরে উঠতে লাগল পুলিশ। পাড়া-প্রতিবেশীরা দোতলায় এসে আটকে গেল। পুলিশি ঝামেলায় জড়ানোর থেকে দূরে থাকাই ভালো। দুজন কনস্টেবল এগোলো দোতলায় ঘরগুলোর দিকে। ডানদিকের প্রথম ঘরে আলো জ্বলছে। একপাশে রান্নার ব্যবস্থা, অন্যপাশে ছোট খাবার টেবিল। পাশে একখানা নতুন ফ্রিজ।


পেছনে আছে একখানা বড় সোফা আর দেওয়ালজোড়া ইউনিট। যেখানে নীচ থেকে ওপরে শৌখিন জিনিসে ঠাসা। সমস্ত ঘর ফাঁকা। পাশের ঘরে ঢুকেই থমকে গেল দুজন কনস্টেবল। খোলা ঘরে বিছানায় পড়ে আছে মেজ ছেলে অতীনের মৃতদেহ। খালি গা। পড়নে একটা লুঙ্গি। শরীরের বেশিরভাগ অংশ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে। বিছানার চাদরে মাখামাখি হয়ে আছে পায়েস। আর লাল পিঁপড়ে দল বেঁধে আছে জায়গায় জায়গায়।


সাব-ইন্সপেক্টর সমেত এক অফিসার সোজা তিনতলায় উঠে ঢুকল বারান্দার ডানদিকের প্রথম ঘরে। ঘরে টিউব লাইট জ্বলছে। টিভিতে গমগমিয়ে চলছে খবর। বাড়ির বড়কর্তা অলোকবাবু লাল মখমলের সোফায় এলিয়ে পড়ে আছে। চোখ খোলা। মুখ হাঁ করা। প্রাণ যে অবশিষ্ট নেই সে কথা প্রথম নজরেই বলে দেওয়া যায়। সাব-ইন্সপেক্টর অভ্যাসবশত টিভির সাউন্ড কমানোর জন্য রিমোর্ট নিতে হাত বাড়াতেই থামালেন অফিসার। সতর্ক করে দিলেন, কোনোকিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। লাল মখমলের ওপরে পড়ে আছে একটা স্টিলের আইসক্রিম কাপ। যার মধ্যে থেকে অনেকখানি পায়েস গড়িয়ে পড়েছে সোফায়।


ইন্সপেক্টর গেলেন ডানদিকের শেষের ঘরে। খাবার ঘর। যার একপাশে রান্নাঘরে জ্বলছে আলো। চলছে এক্সস্ট ফ্যান। বিরাট খাবার টেবিলে সাজানো রয়েছে খাবারের থালা। প্রতিটা থালাতেই কিছু উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। উপবৃত্তাকার বড় টেবিলের চারপাশে রাখা আছে খানছয়েক চেয়ার। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান। পাঁচখানা চেয়ার খালি। একখানা চেয়ার ভরাট করে যে ব্যক্তি,তার মুখ উপুড় হয়ে আছে টেবিলের ওপরে বাঁপাশ করে। বাঁদিকে গিয়ে পুলিশ দেখলো ব্যাক্তিকে। বাড়ির বড় ছেলে অরুণ। মুখ বিকৃত হয়ে ঠেসে গেছে টেবিলের সাথে। চোখ খোলা। সামনে রাখা আছে পায়েসে ভর্তি স্টিলের আইসক্রিম কাপ। বারান্দার বাঁদিকের প্রথম ঘরের বিছানায় পড়ে রয়েছে বাড়ির বড়বৌ মোহনার নিস্পন্দ দেহ। হাতে সেই পায়েসে ভরা আইস্ক্রিম কাপ। পায়েস সমস্ত মেঝেতে উল্টিয়ে আছে। যার ওপরে এখানেও এসে জড়ো হয়েছে পিঁপড়ে। যার মধ্যে অধিকাংশ জমাট বেঁধে গেছে পায়েসের সাথে। পাড়া-প্রতিবেশীর কানে ততক্ষণে চলে গিয়েছে দুঃসংবাদ। পুলিশ খুঁজে দেখছে চারপাশ। খবর পাঠানো হয়েছে ফরেনসিক বিভাগে। দোতলার বাঁদিকের একটি ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। অবিলম্বে ভাঙা হল দরজা। আবিষ্কার হল বাড়ির ছোটছেলে অজয়ের‌ও মৃতদেহ। সমস্ত বিছানায় যেন একটা পুরু রক্তের প্রলেপ পড়েছে। বাঁ হাতের ধমনীতে গভীর ক্ষত। ডান হাতের খোলা মুঠোয় পড়ে আছে একটা লম্বা ক্ষুর। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইতি বাড়িতে পৌছালো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। যারা নিদান দিলেন ছোট ছেলে ছাড়া বাকিদের মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত খাবারে বিষ প্রয়োগে। এবং সেই বিষ ছিল পায়েসে। ছোট ছেলের মৃত্যু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। এবং সম্ভবত আত্মহত্যা। সমস্ত বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলা হল। কোথাও যদি কিছু মেলে। কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। পুলিশ একতলায় নেমে এল। সিঁড়ির দিক থেকে তালা দেওয়া আছে একটা ঘর। যদি কোনো সূত্র মেলে। পুরো বাড়িতে জীবিত একমাত্র সেই মহিলা,যার নাম বনানী পাল। মহিলা বলে যাচ্ছে সে এসবের কিছুই জানে না। সেই মুহূর্তে কিছুই বিশ্বাস করছে না পুলিশ। ভালো করে খানাতল্লাশি করা হল তার ঘর। বেশ বড় আকারের ঘর। একখানা ছোট ডবলবেড খাট পাতা আছে। ঘরের একপাশে বাথরুম। তার বাঁপাশে একটা টেবিলে রান্নার সরঞ্জাম রাখা। ওপরে ওভেন বসানো ছোট্ট সিলিন্ডার। স্টিলের বাসন রাখা আছে একটা কাঠের তাকে। আসবাব তেমন দামি নয়। তবে, পরিপাটি করে সাজানো।


অনেকগুলো মৃতদেহ প্রথম প্রথম পুলিশের মাথা ঝাঁঝিয়ে দিলেও সমীকরণ মেলাতে বিলম্ব হল না। ছোট ছেলে অজয় সবাইকে হত্যা করে নিজে পরে অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছে। আর তদন্তের তেমন প্রয়োজন নেই। পুলিশি কথায় যাকে বলে, ওপেন এন্ড শাট্ কেস। বাকি সব ফরেনসিক রিপোর্টে দেখে নেওয়া যাবে। তবু সন্দেহের তালিকায় থাকল একতলায় থাকা মহিলা। বয়স পঁচিশ। অবিবাহিতা। ঘটনার দিন থেকে একতলার ঘরে ছিলেন। অথচ তিনি নাকি কিছু টের‌ও পাননি!! হতে পারে?!! দরজা বাড়ির ভেতর থেকে তালাবন্ধ ছিল। এবং আশ্চর্যের কথা যে তিনি বলেছেন যে তিনি সেই পায়েস‌ও খেয়েছিলেন।



তিন-চার দিন কেটে যাওয়ার পরে ফরেনসিক ও ভিসেরা রিপোর্টে পাওয়া গেল মৃত্যুর সময়। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ছোট ছেলের মৃত্যুর সময় রাত নটার কাছাকাছি। অথচ বাকিদের মৃত্যু হয়েছে অনেক পরে। তার মানে সবাই যখন বিষাক্ত পায়েস খাচ্ছে তখন ছোট ছেলে অজয় আর ইহজগতে নেই। যদি না পায়েসে আগে বিষ মিশিয়ে থাকে। সবাইকে পাওয়া গেছে আলাদা আলাদা জায়গায়। কিন্তু সবার মারা যাওয়ার জায়গায় একটি জিনিস পাওয়া গেছে। বাটি ভর্তি পায়েস। ফরেনসিক এবং মৃতদের ভিসেরা রিপোর্ট বলছে সোডিয়াম সায়ানাইডের মত মারাত্মক বিষ ছিল পায়েসে।


বাড়ির নিকটাত্মীয়ের মধ্যে সেদিন বাড়িতে অনুপস্থিত ছিল মেজ বৌ শর্বরী। তিনি গেছিলেন তাঁর বাপের বাড়ি ডানকুনিতে। সাথে নিয়ে গেছিলেন নিজের দশ বছরের মেয়ে অঙ্কিতা ও বড় জায়ের বারো বছরের ছেলে অমিতেশকে। ভাগ্যিস! তা নাহলে হয়ত এই দুটো বাচ্চার নিথর দেহ‌ও উদ্ধার হত। কিম্বা, হয়ত কিছুই হত না। কে বলতে পারে! সময় এবং ব্যক্তি বিশেষে তো পরিস্থিতি পাল্টিয়েও যেতে পারে।


অনামিকা পালুই মাইতি বাড়ির একমাত্র মেয়ে। দশ বছরের বিবাহিতা অনামিকার একটি মেয়ে আছে সাত বছরের। স্বামীর নাম পলাশ পালুই। পেশা ব্যবসা। লোহার রডের গোডাউন ভবানীপুর এলাকায়। বাড়ি বেলঘড়িয়ায়। ঘটনার দু-সপ্তাহ কেটে যেতেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটল অনামিকার। অপরাধীকে কোনভাবে না ধরতে পারলে শান্তি পাচ্ছেন না মনে। তার ভাইয়ের পক্ষে এতটা নিষ্ঠুর কাজ করা সম্ভব নয়, সে নিশ্চিত। পোস্ট মর্টেম সেই ধারনাটাকেই উস্কে দিল। কিন্তু, তথ্যপ্রমাণ কিছু নেই। তদন্তের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে আত্মহত্যার আগে ছোট ছেলে অজয়‌ই পায়েসে বিষ মিশিয়েছে। তদন্তের এই গতিপ্রকৃতিতে খুশী নয় অনামিকা পালুই। পুলিশি তদন্তের পাশাপাশি সে নিয়োজিত করতে চায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ঋজুর কথা সে শুনেছে। মাইতি বাড়ির অবস্থান ঋজুর বাড়ির দুই কিলোমিটারের মধ্যেই। ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিল ঋজুর সাথে। ৫ই এপ্রিল দুপুর তিনটের সময় ঋজুর বাড়িতে।



পরবর্তী পর্ব পড়ুন এই লিঙ্কে ক্লিক করে

(বুকমেকার্স ও বন্ধুরা - শারদীয়া ১৪২৭ -এ প্রথম প্রকাশিত। অলঙ্করণঃ আশিস ভট্টাচার্য)

1 Comment


anindya575
Nov 05, 2021

প্রদীপ্ত দে মহাশয় এই প্রজন্মের এর প্রতিভাবান লেখকদের মধ্য অন্যতম এক সেরা লেখক। রহস্য গল্পের তো উনি তুলনাহীন । ওনার লিখিত প্রতিটা গল্পেই এক অধুত মুন্সিয়ানা থাকে । এত নিখুঁত ডেটাইলিং ও প্রতিটা চরিত্রের বর্ণনায় মনে হয় চোখের সামনে ঘটনা গুলো ঘটে চলেছে ।

অসাধারণ রোমহর্ষক টান টান এই গল্পটা আগের পূজা সংখ্যা তেই পড়েছিলাম । এবার ধারাবাহিক ভাবে পড়ার আগ্রহ বিন্দুমাত্র ও কমে যায়নি । আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানাই লেখক ভাইকে ও টিম bookmekers এর সকল সদস্য বৃন্দ কে।

খুব ভালো থাকবেন সবাই ।

Like
bottom of page