১৭ই জুলাই, ১৯১৮ সাল - পশ্চিম সাইবেরিয়ার একাট্রিনবার্গ শহরে রাত নেমে এসেছে। হলুদ হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার আর ঠাণ্ডা হাওয়া কেটে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি। গাড়িটার লক্ষ্য, জনৈক ব্যবসায়ীর বাড়ি ইপাসিয়েভ হাউস। উঁচু কাঠের বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা সেই বাড়িতে গত আটাত্তর দিন ধরে বন্দী হয়ে আছেন রাজা দ্বিতীয় নিকোলাস এবং তাঁর পরিবার।
গাড়িতে বসে থাকা যুবকের নাম ইয়াকভ ইয়ুরোভস্কি। যে বলশেভিক বিপ্লবের আঁচে গা সেঁকছে রাশিয়ান সাম্রাজ্য, ইয়ুরোভস্কি সেই বলশেভিক দলেরই হোলটাইমার। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে তার মাথায় চলছে দলের পরবর্তী কর্মসূচীর হিসেব নিকেশ। পশ্চিম সাইবেরিয়ায় এখনও বলশেভিকদের বিরোধীরা শক্তিশালী। তারা চায় রাজাকে পুনর্বহাল করতে। যুবক জানে, দলের পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসের মূল আলোচনাই হবে এদের নিয়ে। তৈরি হবে সকল রাশিয়ানদের সাম্যবাদী ছাতার তলায় নিয়ে আসার কলাকৌশল। দূর থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসছে উন্মত্ত জনতার চিৎকার। যদিও এই জনতা জানেনা তাদের রাজা বন্দী আছে প্রায় চোখের সামনেই থাকা এক বাড়িতে। মনের অজান্তে একবার পকেটে হাত চলে গেল যুবকের। উপর থেকেই দিব্যি অনুভব করা যাচ্ছে কোল্ট পিস্তলটাকে। জুলাই মাসের শুরু থেকে এই যুবকই বন্দী রাজার দেহরক্ষী।
ইপাসিয়েভ হাউসের ফার্স্ট ফ্লোরে পায়চারি করছেন রাজা দ্বিতীয় নিকোলাস, গত কুড়ি বছর ধরে যিনি ছিলেন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একছত্র অধিপতি। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাঁর স্থান হয়েছে এই চার কামরার দোতলা বাড়িতে। এখানে তাঁর সঙ্গী রানি আলেক্সান্দ্রা, রাজপুত্র আলেক্সিস, চার রাজকন্যা, গৃহচিকিৎসক ডক্টর বটকিন, দুই চাকর, একজন রাঁধুনি এবং ছোটো রাজকন্যার স্প্যানিয়েল কুকুর জেমি। শুতে যাওয়ার সময় হয়েছে। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছানো রাজা এখনও স্বপ্ন দেখেন রাজত্ব পুনরুদ্ধারের। সুবিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা পঞ্চম জর্জ, নিকোলাসের প্রিয় মাসতুতো ভাই জর্জি, সে কি কিছুই করবে না প্রিয় নিকিকে বাঁচানোর জন্য!
দোতলার একটা ঘরে থাকেন রাজা, রানি এবং রাজপুত্র আলেক্সিস। আলেক্সিস হাঁটতে পারে না। ছোট থেকেই সে হিমোফিলিয়ার শিকার। তেরো বছরের রাজপুত্র শুকনো, সাদাটে চোখে চারদিক তাকিয়ে দেখে। আশেপাশে যা ঘটছে তার কিছু কিছু জিনিস বুঝতে পারে, বেশিরভাগটাই পারেনা। এই ঘরের পাশের ঘরটা বরাদ্দ চার রাজকন্যার জন্য। আর দুই ঘরের একটায় ডক্টর বটকিন, অন্যটায় রাঁধুনি-চাকরেরা।
নিচের তলায় থাকে বলশেভিকদের নিয়োগ করা পুলিশ। তাদের উপরে ওঠা বারণ। রাজা এবং তাঁর পরিবার দিনে দু’বার তিরিশ মিনিটের জন্য বাইরের বাগানে যাওয়ার সুযোগ পান। সেখানেও ছায়াসঙ্গী হয় একজন পুলিশ। ইপাসিয়াভ হাউসে আসার আগে সেই পুলিশ কখনো এতো কাছ থেকে রাজাকে দেখেনি। প্রত্যন্ত গ্রামের এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। বলশেভিক দলে নাম লিখিয়েই আজ তার এই পদোন্নতি।
কিছুক্ষনের মধ্যে ইয়ুরোভস্কিকে নিয়ে বাগানে এসে থামল সেই গাড়ি। পার্টির হোলটাইমার থেকে উত্তীর্ণ হয়ে যুবক এখন রেড আর্মির কম্যান্ডার।
ইপাসিয়েভ হাউসে ঢুকেই কম্যান্ডার ইয়ুরোভস্কি সোজা উপরে উঠে গেলেন। দেখলেন আলো জ্বলছে ডক্টর বটকিনের ঘরে। উঁকি দিয়ে দেখা গেলো, বটকিন চিঠি লিখছেন।
- ডক্টর বটকিন, এত রাতে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু, রাজা এবং তাঁর ফ্যামিলিকে এক্ষুনি নিচে না নিয়ে গেলেই নয়।
- কী ব্যাপার কম্যান্ডার, কীসের এতো ব্যস্ততা?
- একাট্রিনবার্গের রাস্তায় উন্মত্ত জনতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলোপাথাড়ি গুলি চলছে চারদিকে। দোতলার ঘরে ফায়ারিং হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। রাজা এবং তাঁর সহচরদের নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে নেমে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।
বটকিন বুঝলেন এটা অনুরোধ নয়, আদেশ। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিঠিটা অপূর্ণ ছেড়ে তিনি টোকা দিলেন রাজার ঘরে।
চল্লিশ মিনিট পর একে একে নেমে এলেন রাজা, তাঁর কোলে অসুস্থ রাজপুত্র, রানি, চার রাজকন্যা, ডক্টর বটকিন, দুইজন চাকর এবং রাঁধুনি, মোট এগারোজন। রাজার পরণে মলিন হয়ে আসা সেনাপোশাক। রাজপুত্রের পরনেও ঢোলা খাঁকি জামা। চাকরেরা সঙ্গে নিয়ে চলল একটা করে বালিশ, যেগুলোর মধ্যে কোনও একটায় লুকানো আছে, দামী গয়নায় পূর্ণ একটা পোঁটলা। ইয়ুরোভস্কির নির্দেশে তাঁরা নেমে এলেন গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা ফাঁকা ঘরে।
ঘরে কোনও চেয়ার নেই দেখে রানি চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমরা কী দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি। চেয়ারের ব্যাবস্থা করুন ইমিডিয়েটলি”।
কোনও বাক্যব্যায় না করে কম্যান্ডার ইয়ুরোভস্কি দুটো চেয়ার নিয়ে এলেন। একটায় রাজা বসিয়ে দিলেন অসুস্থ রাজপুত্রকে, অন্যটায় বসলেন রানী নিজে। বাকিরা দাঁড়িয়ে রইলো। বাইরের গার্ডরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে উঠলো, “The heir needs a chair … evidently he wants to die in a chair.”
ইয়ুরোভস্কি দেরী না করে নির্দেশ দিলেন, “আপনি এদিকে, আপনি ওদিকে এবং আপনারা পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। মস্কোতে জনতার ধারণা হয়েছে আপনারা পালিয়েছেন। সেই ধারনাকে ভুল প্রমাণ করতে একটা সম্পূর্ণ ছবি নেওয়া হবে আপনাদের”।
মোট এগারোজন দাঁড়িয়ে রইলেন দুটি লাইনে।
স্মিত হাসলেন ইয়ুরোভস্কি। সেই হাসি গর্বের, নাকি অবজ্ঞার আমরা জানি না। তারপর হাত তুলে দুবার তালি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করলো রিভলভার-ধারী এগারোজন যুবক। ইয়ুরোভস্কি কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এখন তিনি রাজা নিকোলাসের সামনে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জে দাঁড়িয়ে। ডান পকেট হাতড়ে বের করলেন এক টুকরো কাগজ। সেই কাগজ রাজা ও রাজপরিবারের মৃত্যুর পরোয়ানা। জোরে জোরে পড়লেন ইয়ুরোভস্কি, “In view of the fact that your relatives are continuing their attack on Soviet Russia, the Ural Executive Committee has decided to execute you.”
বিস্ফারিত চোখে পরিবারের দিকে তাকালেন রাজা নিকোলাস। মুহূর্তের মধ্যে ইয়ুরোভস্কির কোল্ট থেকে একটা গুলি রাজাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। বাবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে গেলেন অসুস্থ রাজপুত্র। বাকিরা সেই সুযোগ পেলেন না। একসঙ্গে গর্জে উঠলো সবকটা পিস্তল। লুটিয়ে পড়লেন রানি আলেক্সান্দ্রা, ডক্টর বটকিন এবং আরও সকলে। রাজপুত্র আলেক্সিস মেঝেতে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে যাচ্ছিলেন পিতার মৃতদেহের দিকে। একজন বন্দুকধারীর ভারী বুটের লাথি এসে পড়লো কিশোর রাজপুত্রের মুখে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেন রাজপুত্র। ইয়ুরোভস্কি এগিয়ে এলেন। অসহায় রাজপুত্র দুই হাত জড়ো করে মাথার সামনে এনে চেষ্টা করছিলেন ব্যর্থ প্রতিরোধের। আবারও স্মিত হাসলেন ইয়ুরোভস্কি। রাজপুত্রের কানে এসে ঠেকল ধাতব নল; পরপর দুটো গুলি, তারপর সব চুপচাপ।
বারুদের গন্ধ আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘরটা। চার রাজকন্যার ঘর থেকে চাদর নিয়ে এসে বেঁধে ফেলা হল মৃতদেহগুলোকে। বাইরের বাগানে অপেক্ষা করছিলো একটা ছোট্ট ট্রাক। তার মধ্যে চটপট তুলে ফেলা হল সবকটা দেহ। প্রথমে রাজা, তারপর বাকিরা। হঠাৎ একজন আবিষ্কার করলো, ছোট রাজকন্যার কুকুর জেমিকে। সে তখনো জীবন্ত। বেশিক্ষণ সময় লাগলো না, একটা রাইফেলের বাঁট এসে জেমির মাথাটা থেঁতলে দিলো। ট্রাকের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হলো জেমির ছোট্ট দেহটা।
রাশিয়ান জারতন্ত্রের পতন সম্পূর্ণ হল। আর কোনও দাবীদার রইলো না রাজসিংহাসনের। রাজপরিবারের দেহ থেকে খুলে নেওয়া হল সমস্ত পোশাকআশাক আর গয়নাগাটি। উপস্থিত লোকজন লুটেপুটে নিলো রাজার শেষ সম্বল। শুধু একপাশে পড়ে রইলো চার রাজকন্যার গলায় থাকা চারটি ধাতব লকেট। লকেটগুলোয় শোভা পেতো, এক দাড়িওয়ালা সাধুর ছবি। তাঁর নাম গ্রেগরি রাসপুটিন।
Comments